প্রকাশিত: Sat, Feb 11, 2023 6:41 AM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 7:59 AM

‘রাজনটী’ এবং স্বকৃত নোমান

রেজা ঘটক : ১৭৭০ সালে বা ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ভারতবর্ষে বিশেষ করে বিহার ও বাংলায় অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ফলে এই অঞ্চলে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল। পাশাপাশি ওই সময়ে এই অঞ্চলে গুটিবসন্তের প্রকোপে ভয়াবহ মহামারী শুরু হয়েছিল। একদিকে অনাহারজনিত দুর্ভিক্ষ আর অন্যদিকে গুটিবসন্তের প্রকোপে মহামারী, এই দুই প্রলয়ংকারী মারীতে ভারতবর্ষে তখন এক কোটির বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। ইতিহাসে যাকে গ্রেট ফেমিন অব ইন্ডিয়া বা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। 

দুই মারীর উপদ্রপের পাশাপাশি তখন পূর্ব-ভারতে (বাংলা-বিহার-ওড়িশা) চলছিল দ্বৈত শাসন। দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে ইংরেজরা এর আগেই দেওয়ানি লাভ করেছিল। এতে নবাবের হাতে থাকে নামসর্বস্ব প্রশাসনিক দায়িত্ব, কিন্তু রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফলে বাংলার নবাব আদতে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে চালায় অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার। 

একদিকে প্রাকৃতিক মহামারী আর অন্যদিকে ইংরেজদের অত্যাচার ও নির্যাতনে গোটা পূর্ব-ভারতে তখন ত্রাসের রাজত্ব চলতে থাকে। এই অঞ্চলে তখন জনসংখ্যার অন্তত এক তৃতীয়াংশ মারা যায়। যা ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এরকম একটি বিক্ষিপ্ত সময়ে লোকপুরাণের এক বাইজিকে নিয়ে 'রাজনটী' উপন্যাসের আখ্যান সাজিয়েছেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান।  

উপন্যাসে এই বাইজির নাম গুলনাহার। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় গুলনাহারকে বিক্রি করে দিয়েছিল তার মা। তখন তার ঠাঁই হয়েছিল জাজিনগরের (প্রকৃত নাম হয়তো রাজাজিনগর) রাজধানী উদয়াচলের এক বাইজিকোঠায়। রূপ, যৌবন, নৃত্য ও গীতে গোটা রাজ্যেজুড়েই তখন তার চূড়ান্ত খ্যাতি। মহারাজ থেকে শুরু করে মন্ত্রীবর্গ, জমিদার ও বণিকরা তখন গুলনাহারের জলসায় আসতেন। একদিন যুবরাজ কর্তৃক লাঞ্ছিত গুলনাহার উদয়াচল ত্যাগ করে অজানার উদ্দেশে রওনা দেয়। তখন তাকে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখান পণ্ডিত অজয় কুমার। পণ্ডিতের সহযোগিতায় সে জন্মভূমি হরিদশ্ব গ্রামে আবার ফেরত আসে। কিন্তু ততদিনে তার পৈতৃকবাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। চিরতরে বাইজিবৃত্তি ছেড়ে তখন গুলনাহার শুরু করে আরেক নতুন জীবন। 

গুলনাহারের বাইজি হবার কথা গ্রামবাসী জানত না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে গুলনাহার তখন গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু একদিন তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায়। এতেই বিপত্তির শুরু। গোটা সমাজ তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেল। গ্রামবাসী তার নির্মিত মসজিদে নামাজ পড়তে অস্বীকৃতি জানাল। এভাবেই উপন্যাসের বিস্তার। ইতিহাসের বিক্ষিপ্ত দগ্ধসময়, লোকপুরাণের বাইজি ও লেখকের কল্পনার মিশেলে রচিত এই উপন্যাস ‘রাজনটী’। কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের 'রাজনটী' উপন্যাসটির যূগপূর্তি সংস্করণ প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ। 

সমকালীন সাহিত্যে কোনো একটি উপন্যাসের যুগপূর্তি সংস্করণ প্রকাশ পাওয়া যে কোনো লেখকের জন্য নিশ্চয়ই গৌরবের। স্বকৃত নোমানকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আমি সময় সুযোগমত 'রাজনটী' অবশ্যই পড়ব এবং তখন একটি রিভিউ লেখার ইচ্ছে রইল। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল।